.: পুতুলের চিতা

.: পুতুলের চিতা









দুই বেলা তোর চিবুক ছূঁয়ে বলতে ইচ্ছে করে
এই বোকা শোন তোর লাগি মোর পরান কেমন করে'।

উল্টো হাতে ঠোঁটের কোনের আধলা একটা ঘাম
ইচ্ছা করে মুছায়ে দি হয় যদি আরাম।

তিন বেলা রোজ পাশে বসায় নলায় গরাস তুলে
ইচ্ছা করে খাওয়ায়ে দি, লোক সমাজকে ভুলে।

চাঁদ কপালে হাত বুলায়ে ঘুম পাড়াবো রাতে
বুকের মধ্যে পিষে রেখেই ঘুমাবো তোর সাথে।

ইচ্ছারা রোজ মিছিল করে তোর এলাকায় ঘুরে
স্লোগান দিয়ে গলা ফাটায় উচ্চকিত সুরে।

তুই কি জানিস তোর লাগি এই পরাণে হা পিত্যেস?
হাহাকারের অগ্নিতে হয় ইচ্ছেরা নিঃশেষ।

বৃষ্টি দুপুর টাপুর টুপুর সোনার নুপুর পায়ে
ইছেরা সব নেচে বেড়ায় তোর হৃদয়ের গাঁয়ে।

তোর শুধু এই পলাই পলাই উড়নচন্ডি মন
একটু থিতু হ’ না দোহাই-একটু কথা শোন।












"চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হও...” রেডিও তে গান টা শুনতে ভালই লাগছে।

আজ জুন মাসের 4 তারিখ, বাংলা মাস হিসাবে জ্যৈষ্ঠ চলছে। বৃষ্টি বাদলা হচ্ছে মাঝে মাঝে, কিন্তু গরমটাও প্রচণ্ড। আজকে আবহাওয়াটা অবশ্য ভাল, আকাশটা বেশ মেঘলা মেঘলা সকাল থেকেই। একটু পর পরই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একটা চায়ের দোকানে বসে আছি। মামা লাল চা টা বেশ ভাল বানায়, সাথে টানছি বেনসন। চা খেতে খেতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন লাল চায়ের সাথে প্রেমিকার অমৃত ঠোঁটের লালার তুলনা বিষয়ক একটা লেখা পড়েছি সেদিন। চা খাওয়ার সময় কথা টা মনে পড়লেই কেমন জানি গা গুলাতে থাকে, কোন মানে হয়?

রাস্তায় মানুষজন ব্যস্ত ভাবে চলাফেরা করছে, প্রচুর রিকশা আর প্রাইভেট গাড়ি। আমার দিকে সব মেয়েদের উৎসুক দৃষ্টি ভালই খেয়াল করছি। মনে মনে হাসি আমি, আর ভাবি যে ওদের তো কোন দোষ নেই, খোদা আমাকে বানিয়েছেনই এমন। কি আর করা! চা শেষ করে দাম মিটিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করি, বাসায় যাওয়ার আগে আমার কি জানি নেয়ার কথা। হাঁটছি আর ভাবছি, হঠাৎ কানের কাছে কে যেন আচমকা একটা ফুঁ দিল, চমকে উঠলাম। প্রায় সাথে সাথেই বুঝতে পারি শিমুলের কাজ। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু কিছু বললাম না। শিমুল সব সময়ই কেমন অস্থির অস্থির, চোখ গুলি অনবরত নড়াচড়া করে। দেখলেই মনে হয় ঘোর অসুস্থ মানুষের দৃষ্টি। শিমুল চুপচাপ আমার সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটছে আর ইতিউতি তাকাচ্ছে। একটু পর শিমুল বলল,
-"কিরে অনেকদিন তো হয়ে গেল, আর মজা হবেনা?"
-"হবে, হবেনা কেন? তুই জানিস না এগুলোতে একটু সময় লাগে?"
-"হাহাহা, তা অবশ্য লাগে। ঠিক আছে দেখা যাক…”, শিমুল যেমন হঠাৎ আসে তেমনি হঠাৎ চলে যায়। আমি আবারো হাঁটতে থাকি। মনটা বিষিয়ে আছে শিমুলের কথা শুনে। আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় যে অনেকদিন ধরেই মনমতো মজাটা করতে পারছিনা! ইচ্ছেটা প্রচণ্ড ভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে প্রায়ই, কিন্তু অনেক ঝামেলা, ঝুঁকিও বেশি আজকাল। মাথার ভেতরে সব মিলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এসময় আমি আটকে গেলাম।

আমি হাঁটছিলাম গলিটার বাম দিক দিয়ে। গলির দুই দিকেই আবাসিক দালানকোঠা আর ছোটছোট দোকানপাট। রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা হুড তোলা রিকশা এসে থামল ঠিক আমার বামের লাল গেটটার সামনে, আরোহী একটা মেয়ে। নামল মেয়েটা, হাত বাড়িয়ে রিকশাওয়ালাকে টাকা দিল। ফর্সা হাতের কব্জিতে চিকন একটা সোনালী ব্রেসলেট। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল, আমি সেই চোখেই আটকা পড়লাম। মেয়েটার চোখেও মনে হয় বিস্ময়ের ছায়া দেখতে পেলাম একটু, কিন্তু এক মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটা গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।

আমি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে সেই বহু পরিচিত অনুভূতিটা মোচড় দিয়ে উঠছে! কোন কিছুকে পাওয়ার অদম্য আকুলতা, তীব্র ইচ্ছাটা আমাকে অবশ করে দিচ্ছে। নিজেকে সামলানোর প্রবল চেষ্টা করি আমি, বাইরে দিয়ে স্বাভাবিক থাকতে হবে অন্তত যেভাবেই হোক। কিন্তু ওই চোখ দুটো তো সব উলটপালট করে দিচ্ছে! মনের অজান্তেই ঠিক করে ফেলি ঐ চোখদুটোকে আমার খুব কাছে থেকে দেখতে হবে, খুউব কাছে থেকে, এত কাছে থেকে যে আমার মুখে যাতে মেয়েটার নি:শ্বাসের ছোঁয়া পাই। চূড়ান্ত সময়টাতে ওর চোখের তারার দিকে তাকিয়ে কি দেখতে পাব ভাবতেই আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠে! রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন রোমাঞ্চ খেলা করতে থাকে, নেশা নেশা ভাব হয়...

বাড়িটা চিনে রেখে আবার হাঁটতে শুরু করি। মনে মনে অনেক কিছু ভাবছি, এই সময় আবার শিমুলের যন্ত্রণা শুরু হল,
-"কিরে পেয়ে গিয়েছিস মনে হচ্ছে!"
-"হুমম... হয়তো"।
-"খিক খিক... মেয়েটাকে দেখে তোর তো অবস্থা কেরোসিন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তুই ভিতরে ভিতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছিস! আহা! কবে করবি কাজটা?”
-"দ্যাখ ভ্যাদড় ভ্যাদড় ছাড়! এত বিরক্ত করিস ক্যান? তখন বললাম না এসবে একটু সময় লাগে... বাংলা বুঝিসনা নাকি?"
-"মেয়েটা কিন্তু একটা জিনিস রে!! লোল টানার মত আওয়াজ করে শিমুল, গলা উত্তেজনায় কেমন যেন ঘড়ঘড় করতে থাকে। “পারলে আমিই...”, আমার রক্তচক্ষু দেখে মিইয়ে যায় ও।
-"ঠিক আছে আমি চুপ করছি, কিন্তু ভাই খুব বেশি সময় নিস না। গরম গরম জিলাপির মজাই আলাদা!!”

হঠাৎ মনে পড়ল আম্মা মেঘলা দিন দেখে খিচুড়ি করবে বলছিল, তাই আমাকে মুদি দোকান থেকে মুগ মসুর ডাল নিতে বলেছে। সামনেই স্টোর, তাড়াতাড়ি পা চালাই আমি।



কার্জন হলের বাইরে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছি। সিগারেট টা শেষ করে হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ১টা বেজে ৩৮ মিনিট। রিক্তার তো এতক্ষণে ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। রিক্তার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এক বন্ধুর জন্মদিনে, আমাদের এলাকাতেই বাসা। তারপর আরেকবার দেখা হয় ঐ বন্ধুর বোনের বিয়েতে। তারপর থেকে আমাকে মাঝে মধ্যে ফোন করে, টুকটাক এস.এম.এস দেয়। রিক্তা বহুবার, কখনো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কখনো বা সরাসরি আমাকে ওর সাথে ঘুরতে যাবার, সময় কাটাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এতদিন তেমন একটা পাত্তা না দিলেও আজকে চলে এসেছি। কারণটা ভাবতেই আমার একটু হাসি পেয়ে যায়।

মাথাটা ঘুরিয়ে আবার গেটের দিকে তাকাতেই রিক্তাকে চোখে পড়ল, সাথে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব সহ বের হয়ে আসছে। আমি এগিয়ে গেলাম, ডাক দিলাম “এ্যাই রিক্তা!” সবাই ফিরে তাকাল। রিক্তাকে দেখে মনে হচ্ছে ও নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেনা।
-"আরে তুমি? কালকে তো ফোনে একবারও বললানা যে আজকে এখানে আসবা!"
-"ইচ্ছা করেই বলিনি। তোমাকে চমকে দিলাম।"
-"তাই নাকি?" ভ্রুকুটি করে রিক্তা। "স্ট্রেঞ্জ... এনিওয়ে পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে ফারিয়া, ও নীলু, এটা মেহরীন আর ও হল বিপাশা।" আমি সবার সাথে হাসিমুখে পরিচিত হলাম। হুমম ওর নাম তাহলে বিপাশা। মেয়েটা যে অদ্ভুত সুন্দরী আজকে আরও ভালমতো উপলব্ধি করলাম। সেদিন তো চোখ ছাড়া আর কিছু খেয়ালই করিনি। রিক্তা তো খুশিতে ঝলমল করছে যে আমি আজকে ওর সাথে দেখা করতে এসেছি। হায়রে, সত্যি কথাটা যদি জানত!! অন্য মেয়েগুলোর চোখে মুখেও বেশ মুগ্ধতার ছাপ দেখা যাচ্ছে। বিপাশার চোখের দিকে তাকাচ্ছিনা, বেসামাল না হয়ে যাই আবার। আর ওকে এখন বেশি পাত্তা দেয়াও ঠিক হবেনা, টেকনিক্যাল সমস্যা আছে।
-"রিক্তা চল, আজ আমরা সবাই একসাথে লাঞ্চ করব। না করতে পারবেনা, কারণ আমি জায়গা বুক করে এসেছি...”, আমি আবদার করলাম।
মেহরীন বলল ওর অন্য জায়গায় একটা জরুরী কাজ আছে, তাই সে যেতে পারবেনা। বাকীরা সবাই প্রথমে একটু আধটু আপত্তি করল, রিক্তাও চাচ্ছিল না মনে হয় অন্য কেউ আসুক আমাদের সাথে, কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে অবশেষে সবাই রাজি হল।

গাড়ি চালাচ্ছি, পাশে রিক্তা বসেছে, পিছনে অন্যরা। সবাই অনবরত কথা বলছে। রিয়ারভিউ মিররে হঠাৎ খেয়াল করলাম বিপাশা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কি আমাকে চিনতে পেরেছে? চিনলেও সমস্যা নেই। যে করেই হোক আমাকে আজকের পুরো সময়টা নিখুঁতভাবে কাজে লাগাতে হবে, একটাও ভুল করা যাবে না। আসার পথে শিমুলের ফিসফিস করে বলা কথাটা বারবার কানে বাজছে, "মামা, আমার তো আর তর সয়না... শালা কতদিন পর...!! " লোল টানার মত শব্দটা আবার করেছে শিমুল!

ব্যুফে রেস্টুরেন্ট টা অনেক নামকরা আর দামী। ম্যানেজার থেকে ওয়েইটার সবাই আমার পরিচিত। তাই ঢোকামাত্রই ম্যানেজার আমাদেরকে আমার বুক করা টেবিলে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সবাই যে যার মতন বসে পড়ছিল, আমি টুক করে ফারিয়ার চেয়ারটা টেনে ধরে বসতে অনুরোধ করলাম। ফারিয়া হাসতে হাসতে বলল,
-"কি ব্যাপার? আমি ছাড়া তো এখানে আরও মেয়ে আছে, বিশেষ করে সুন্দরীদের কথা যদি ধরি।"
-"নীলু একটু উঠবেন? ফারিয়া চাচ্ছে আমি আপনার চেয়ারটাও টেনে ধরি", আমি গম্ভীর হবার ভাব করি।
-"আপনি তো দেখি কানা", ফারিয়া বলল।
-"স্বাভাবিক, ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি।"
সবাই হেসে উঠল। পরিবেশটা অনেকই সহজ হয়ে উঠেছে। পুরোটা সময় ধরে শুধু বিপাশাকে সযত্নে ইগনোর করে যাচ্ছি।

ঘণ্টা দুই পরে খাওয়া দাওয়া শেষে একে একে সবাইকে যার যার গন্তব্যের কাছাকাছি নামিয়ে দিচ্ছি। রিক্তার বাসার কাছাকাছি এসে গাড়ি পার্ক করে নামলাম। রিক্তা বের হয়ে ফিসফিস করে বলল, "থ্যান্ক ইউ রিশাদ, আমি কতটা খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে, বলে বোঝাতে পারবনা। রাতে কথা হবে..."। তারপর বিপাশাকে বাই বলে হেঁটে চলে গেল।
এখন গাড়িতে রয়ে গ্যাছে শুধু বিপাশা, পিছনে সে চুপচাপ বসে আছে।
-"কি ব্যাপার আপনি বসে আছেন কেন? নামেন।”
-"মানে আমার বাসাটা তো আরেকটু সামনে, এই তিনটা গলির পর”, বিপাশাকে একটু অপ্রস্তুত দেখায়।
-"আমি আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে বলেছি!”
বিপাশা অপমানে কাঁদবে না রাগ করবে বুঝতে পারছিলনা বোধহয়। গাড়ি থেকে নেমে গেল শক্ত মুখে। আমি সাথে সাথে ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে ধরলাম।
-"আমাকে আপনার ড্রাইভার হিসেবে একদমই চিন্তা করতে পারছিলাম না”, আমার বহু সাধনায় রপ্ত মন ভুলানো হাসিটা উপহার দিলাম।
বিপাশা মানা করে দিল, সে এখান থেকে একাই চলে যেতে পারবে। আমি অনেক মাফ টাফ চাইলাম এইরকম মজা করার জন্য , অবশেষে সে আবার গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট করলাম। কিছুক্ষণ পর বিপাশা বলল, "এত নাটকীয়তার কী দরকার ছিল?"
-"কী দরকার ছিল জানিনা। আপনার খারাপ লাগেনি তাতেই আমি খুশি।”
-"বাব্বাহ্‌ !! এত কনফিডেন্স নিজের উপর?" বিপাশা সোজা সামনে তাকিয়ে কথা বলছে।
-"মুখে শুধু একবার বলেন যে আপনার ভাল লাগেনি", ওর দিকে তাকালাম আমি, দেখলাম ঠোঁটের কোনায় একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠেছে। প্রাথমিক জয়ের আনন্দে ভিতরটা আবার শিরশির করে উঠল আমার।
-"আপনার চোখ কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর", সত্যি কথাটাই বললাম আমি।
-"তাই নাকি? কিভাবে বুঝলেন? আমার দিকে তো একবারও ভাল মতন তাকাননি আপনি।”
-"তার মানে সারাক্ষণ আমাকে খেয়াল করেছেন?"
বিপাশা লজ্জা পেয়ে গেল এবার। আমি বললাম, "আপনার সাথে তো এটাই আমার প্রথম দেখা না তাই না?"
-"হুমম...”, ওর ছোট্ট উত্তর।
-"তার মানে আপনার মনে আছে?"
-"হুমম আছে...”, বিপাশা আবার চুপচাপ।
ওদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি প্রায়। বললাম, "আপনাকে ফোন করব বিপাশা, নাম্বারটা দেবেন?"
-"এত তাড়াতাড়ি? দেখেন আমি আসলে সহজে কাউকে আমার নাম্বার দেইনা... জানেনই তো মেয়েদের অনেক সমস্যা হয়।”
-"জীবনে সব কিছুই তো কোন না কোন সময় প্রথমবারের মত করতে হয়....একবার সহজে নাম্বার টা দিয়েই দেখেন না হয়”, আমি হাসতে হাসতে বললাম।
-"আচ্ছা ঠিক আছে, আমার নাম্বার ০১৬১৫*****, এটা সবসময় আমার সাথে থাকেনা, শুধু রাতে অল্প সময়ের জন্য খুলি। আর শোনেন প্লিজ ১২ টার আগে ফোন দিয়েন, আমি ১২ টার পর রাতে কথা বলিনা।”
-"চিন্তা করবেন না, আমি এমনিতেও এতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না। আমার ধৈর্য অন্যদের চেয়ে অন্তত ২৫/৩০ কেজি কম।”
কথা শুনে বিপাশা হেসে উঠল। সামনেই ওদের বাড়ির লাল গেটটা দেখা যাচ্ছে।



প্রায় চার মাস হতে চলল, বিপাশাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। এই কয় মাসে তেমন কিছু বদলায়নি, বদলেছে শুধু ও। এখন রাত ১২ টা কেন, সারারাত কথা বললেও বিপাশার আশ মেটেনা। দুই দিনের বেশি না দেখলে পাগলামি কান্নাকাটি করে। আমাকে কাছে পেলে একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়। হাসে, প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়, সংসারের স্বপ্ন দেখে, কয়টা বাচ্চা হবে সেটা নিয়ে গাল ফুলিয়ে ঝগড়া করে। আমি সবকিছু সযত্নে সহ্য করি। কোন ভুল করা যাবেনা! শেষ সময়ে সামান্য একটা ভুলও সব কিছু ভেস্তে দিতে পারে। বিপাশা প্রায়ই বলে, "তুমি এত সুন্দর, এত ভাল। আমার ভয় হয় মাঝে মাঝে, হয়তো কোনদিন দেখব ঘুম ভেঙে গেছে আর আমি স্বপ্ন দেখছিলাম।” আমি কিছু বলিনা। ওর চুলগুলোতে হাত বুলাই আস্তে আস্তে। বিপাশা আমার কাঁধে মাথা রেখে হেলান দেয়।
-"তুমি আমাকে যদি কখনো ছেড়ে চলে যাও, আমাকে আত্মহত্যাও করতে হবেনা জানো? আমি এমনিই মরে যাব”, ও প্রায়ই বলে একথা।
আমি মাথার ভিতর থেকে শিমুলের নোংরা হাসি শুনতে পাই। লোল টেনে টেনে হাসে, অসহ্য!! মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় আমার।

রাত ১১ টা বাজে এখন। বিপাশাকে ফোন করলাম। ধরেই ওপাশ থেকে বলল,
-"এ্যাই তুমি কি করে জান আমি কখন তোমার কথা ভাবি?"
-"এহ্‌ তুমি তো সারাক্ষণই আমার কথা ভাব... এর মধ্যে আবার জানাজানির কি আছে?"
-"আ-হা!! জ্বি না.... কক্ষনো না....”
-"শোন কাজের কথা, কালকে তো উইকেন্ড। অনেক দিন দূরে কোথাও যাইনা। চল কাল লং ড্রাইভে যাই, সাভারে আমাদের একটা ফার্ম হাউস আছে, তোমাকে দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
-"ঠিক আছে, যাওয়া যায়, কিন্তু সারাদিন লাগবে তো, বাসায় কি বলব?"
-"কিছু একটা বানিয়ে বলে দাও, যেভাবেই হোক ম্যানেজ কর না।”
-"আচ্ছা আর কেও যাবে আমাদের সাথে?" বিপাশা জিজ্ঞেস করল।
-"নাহ, জামাতে লং ড্রাইভে যাব নাকি? কি যে বল না বল।”
-"ঠিক আছে, কখন যেতে হবে?"
আমি সাবধানে স্বস্তির একটা চাপা নি:শ্বাস ছাড়ি। যাক রাজি হয়েছে।
-"সকাল ৯ টায় বড় রাস্তার মোড়ে থেক। আমি তোমাকে তুলে নেব।”
-"আচ্ছা এখন রাখি তাহলে, ওই যে মা ডাকছে। আমি কথা বলে তোমাকে পরে কনফার্ম করছি। মিস ইউ আমার চড়ুই পাখি... উম্মা-হ্।”
-"ওকে বাই”, আমি রেখে দিলাম। এবার আগামীকালের জন্য একটু প্রস্তুতি নিতে হবে। পুরোদিন কিভাবে কি করব সবকিছু আরেকবার ভালমতো মাথার ভিতরে সাজিয়ে নিলাম। এতদিন ধরে একটু একটু করে সাজানো আমার অ্যালিবাই গুলো আবার চেক করলাম। নাহ্‌ সবকিছুই পারফেক্ট মনে হচ্ছে। আচ্ছা মেয়েটা বেশি কিছু চিন্তা না করে একেবারেই রাজি হয়ে গেল! ছেলেরা মেয়েদের কেন ফ্ল্যাট, বাগানবাড়ি বা ফার্ম হাউসে নিয়ে যেতে চায় তা তো সবাই বুঝে আজকাল। প্রেমে পরলে মেয়েগুলা এত বোকা হয়ে যায় কেন কে জানে! নাকি বেশি মডার্ন, আমিই বুঝিনাই। যাই হোক আমার কাজ হলেই হল। ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে শুয়ে পরব ভাবছি যদিও জানি আজকে রাতে উত্তেজনা আর অস্থিরতায় ঘুম হবেনা। এই পর্যন্ত কখনো হয়নি। তাও নার্ভ ঠিক রাখতে হবে যথাসম্ভব, না হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারবনা।

পরদিন সাভারে পৌঁছতে পৌঁছতে ১১.৩০ বেজে গেল। ফার্ম হাউসের তালা খুলে ভিতরে ঢুকতেই বিপাশা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আজ অবশ্য সকাল থেকেই তার মুড একটু বেশিই ভাল। যা দেখছে তাতেই মুগ্ধ হচ্ছে। আমার ফার্ম হাউসটা অনেক বড় আর ছবির মত সুন্দর, একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে আর ২ জন গার্ড আছে। আজকে অবশ্য সবাইকে ছুটি দিয়েছি আমি। বিপাশাকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পুরোটা দেখালাম। এক পর্যায়ে বলল ওর খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। ওকে দোতলায় রেখে আমি পানি আনতে গেলাম। পানি নিয়ে ফিরে এসে দেখি সে রুমে নেই। ডাকলাম, "বিপাশা... এ্যাই বিপাশা.... কোথায় তুমি?"
-"আমি এখানে.... বারান্দায়... চলে আস।”
পানির গ্লাস নিয়ে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম বিপাশা এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
-"এই নাও, ঠাণ্ডা পানি", পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম।
-"থাক লাগবে না, ইচ্ছা করছেনা।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার কি খারাপ লাগছে নাকি?"
উত্তরে বিপাশা কিছু বললনা। দুইজনেই চুপ করে আছি। ও কি ভাবছে জানিনা। আমি ভাবছি কিভাবে আমার কাজ শুরু করব। এখন নাকি আরও পরে? একটু বেশি নার্ভাস লাগছে আজ, বেশ অনেক দিন পর তো!
-"আচ্ছা তুমি আমাকে ফার্ম হাউসে আনতে গেলে কেন?", বিপাশার প্রশ্নে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই।
-"এমনিই। ভাবলাম এত সুন্দর একটা জায়গা আছে আমার, তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”
-"চাপা মেরোনা। তুমি আমাকে কি ভাব? দুধের শিশু? ছেলেদেরকে আমি চিনিনা?" বিপাশার কণ্ঠে হালকা বিদ্রুপ।
-"এত সন্দেহ থাকলে আসলে কেন?? কাল তো বলা মাত্রই রাজি হয়ে গেলে। আজব!”, আমি বললাম।
-"কেন এসেছি জান? আমার একটু কাজ ছিল তাই। নিজে থেকে বলাটা আমার জন্য একটু কঠিন হয়ে যেত, কিন্তু তুমি বলায় আমার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গ্যাছে”, বিপাশা এবার ঘুরে আমার দিকে সরাসরি তাকালো, মুখে মুচকি মুচকি হাসি।
বিপাশাকে হাসলে অনেক অনেক সুন্দর দেখায়, আজকেও দেখাচ্ছে। ও কিছু সন্দেহ করেনি মনে হচ্ছে, করলে নিশ্চয়ই এত সুন্দর করে হাসত না।
-"আমি তোমার সাথে এসেছি কারণ তোমাকে একটু কাছে পেতে চাচ্ছিলাম, একেবারে নিজের করে। কেউ থাকবেনা আর, শুধু তুমি আর আমি।”
বিপাশা আমার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে, ওর চোখের দিকে এবার খেয়াল করলাম আমি, মনের সুপ্ত উদগ্র কামনা চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে চকচক করছে।
হঠাৎ শিমুলের চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, উত্তেজনায় কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলছে, "রিশাদ...এই সুযোগ। বেডরুমে নিয়া সুযোগ মত কাম তামাম কইরা দে...!!”
কিন্তু কেন জানি আমার একটু খুঁতখুঁত করছে মনের মধ্যে, কোথাও কি কোন গণ্ডগোল আছে? এসব ভাবতে ভাবতে দুই সেকেন্ডের জন্য একটু আনমনা হয়ে গেছি, এর মাঝে বিপাশা একদমই আমার কাছে চলে এসেছে, মুখে অদ্ভুত মিষ্টি দুষ্ট হাসি। কাছে এসে ও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ওকে জড়িয়ে ধরে এরপর কি করব না করব ভাবছি, হঠাৎ মনে হল আমার ডান দিকে পাঁজরের সামান্য নিচে কিছু একটা ঢুকে গেল। কি এটা? প্রচণ্ড ব্যথায় আমার গা গুলিয়ে উঠতে থাকে, মাথাটা হঠাৎ করে পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ধীরে ধীরে বুঝতে পারি বিপাশা আমার শরীরে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি আমাকে ছেড়ে এক পা দুই পা করে পিছনে সরে যাচ্ছে আর হাহাহা করে হাসছে। আমার দৃষ্টি ক্রমশ: ঝাপসা হয়ে আসে। কোনরকমে কিছু একটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, পারি না, পড়ে যাই। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে রুমের দেয়ালের কাছে গিয়ে হেলান দিয়ে শুই। প্রচণ্ড হাঁপ ধরে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে মগজটা বোধহয় এখনি নাকের ফুটো দিয়ে বের হয়ে আসবে। কোন রকমে যদি এ যাত্রায় বাঁচতে পারি... দেখতে পাই বিপাশা হাসতে হাসতেই পকেট থেকে চারকোণা একটা মডিঊল বের করছে, সাথে সাথেই জিনিসটা চিনতে পারি আমি। এটা আমারও একটা আছে, তার মানে... তার মানে হচ্ছে বিপাশাও আমার মত একজন ...


স্বয়ংক্রিয় ভাবে ক্যাপসুলের ঢাকনা টা খুলে যায়, ঘাড়ের পিছন থেকে সাইবারনেটিক কর্ডটা খুলে রাখে রিশাদ। সারা শরীর ঘামে ভিজে একাকার। নিজের বোকামির কথা মনে পড়ায় মনটা বিষিয়ে ওঠে প্রচণ্ড। এতদিনের পরিশ্রম, আট লক্ষ পয়েন্ট সব শেষ!! গলা ছেড়ে বিকট একটা হাঁক দেয়,
"কালাম, সিস্টেম রিস্টার্ট দে, আমি আবার প্রথম থেকে খেলব।”





১.
গল্পটি মাত্র সোয়া তিন পৃষ্ঠার। লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। নাম ভিক্টোরিয়ার হিরো।

শুরুর সময়টা ১৮৬৯ ইং। তখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়ে গেছে। বয়স আট। বাবার সঙ্গে হিমালয়ে গেছেন। মীরাট, না, দিল্লীতে সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হয় গেছে। এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। শ্যামল আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন মাছরং গ্রামে। থানা--বানারীপাড়া। জিলা--বরিশাল। ধানকাটা শেষ হয়ে গেছে। নদীর পাড়ে পালাগান বসেছে। দলের নাম নট্ট কোম্পানী।

রাধাকৃষ্ণের পালা। আয়ান ঘোষ সেজেছেন গিরিশ গাঙ্গুলি। তিনি খুব চিন্তিত। তার ছয়টি মেয়ে হয়েছে। আবার বাড়িতে দাই এসেছে। বাড়িটা পালামাঠের ওপারে--বাইশাড়ি গ্রামে। আজ আরেকটি ছেলে কি মেয়ে হবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে গানের বানী গেছেন ভুলে। গেয়ে উঠেছেন--আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়ে। ভাগ্নে কৃষ্ণের সঙ্গে অভিসারে চলেছে আয়ানের বউ রাধা। এই গানটিও আখ্যানের সঙ্গে লেগে গেছে। লোকের চক্ষে জল। এ সময়ই বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশ নন্দিনী বলে একটা বই লিখে ফেলেছেন। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ায় রেলগাড়ি এসে গেছে। বরিশালে রেলগাড়ি আসবে না। এত নদী পার হয়ে কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম এসে পড়েছে। ঠিক এ সময়ই সন্ধ্যানদী পার হয়ে বানারীপাড়ার বিখ্যাত দাই উষাঙ্গিনী নট্ট কোম্পানী অধিকারী বৈকুণ্ঠ নট্টের কানে কানে এসে বললেন, নট্ট মশাই গিরীশচন্দ্রের আবারও মেয়ে হয়েছে। তার সাহস নেই সদ্যোজাত মেয়েটির বাবা গিরিশের কানে খবরটি পৌঁছে দেওয়ার।

শ্যামল লিখেছেন, পালাগানতো থেমে থাকতে পারে না। বৈকুণ্ঠ নট্টকে ঘিরে বসা বাঁশিবাজিয়েরা ততক্ষণে কৃষ্ণের বাঁশির টান ধরেছে। কিন্তু আজ যে নিশিথিনী ননদিনী জেগে থাকবে পাহারায়। এর পরের বিবরণটুকু শ্যামল দেন না। আমাদের মর্মে এসে পড়ে। এর মধ্যেই রাধিকা অভিসারে যাবেন। যাওয়াটাই নিয়তি। গিরিশ গাঙ্গুলির অবাক করে বলে দিলেন উষাঙ্গিনীকে, মাইয়ার নাম দিলাম ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়া মা ভালো আছে। গল্পটি এই ভিক্টোরিয়া মাকে নিয়েই।

দেড় পৃষ্ঠা পার হওয়ার পরেই আমরা বুঝতে পারি--এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। বঙ্কিমচন্দ্র ঋষি হয়ে স্বর্গে গেছেন। নট্ট কোম্পানী কলকাতায় শোভাবাজারে বাড়িভাড়া করে অফিস খুলেছে। গিরিশচন্দ্র জোড়া মহিষ মানত করে ছেলের বাবা হয়েছেন। সেই ছেলে এখন খুলনার কোর্টে কাজ করেন। কিরণকুমারী নাম তার বউয়ের। দুতিনটে ছেলেমেয়ে। কিরণকুমারী ভিক্টোরিয়ার ননদিনী।

ভিক্টোরিয়ার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মুখরা বলে তিনদিনও স্বামীর সংসারের টিকতে পারেনি। ভাইয়ের সংসারে এসেছে। সেটা ১৯২৫ সালের কথা। তখন দেশবন্ধু পরপারে। গিরিশচন্দ্রও। ইংলন্ডেশ্বরী রানী খোদ ভিক্টোরিয়ার নামে কলকাতার বুকে গড়ের মাঠে বাড়ি উঠেছে। মো. গান্ধী নামে একজন লোক প্রায়ই জেলে যান।খুলনায় কিরণকুমারী দিনে ঘরের কাজ করেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। জেগে জেগে ননদিনীর পাহারায় থাকেন। ননদিনী ভিক্টোরিয়া প্রদীপা জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের ছবির সামনে অভিসারী রাধিকা হয়ে নাচেন। কিরণকুমারীর ভয়--পাছে কাপড়ে আগুন লেগে যায়। ভিক্টোরিয়ার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। ষাটের কাছে এসেছে। নাচতে গেলে পা ভাঙতে পারে। কৃষ্ণই তার স্বামী। বহুদিন আগে তাঁর নিজের স্বামীটি মারা গেছেন। তাঁর কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। তবু তিনি থান পরেন।

এক সন্ধ্যায় ভৈরব নদীর পাড়ে কিরণকুমারী ননদিনীকে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখান থেকে বাতাসা পেয়েছেন। ফেরার পথে বাতাসাখানি হাত থেকে পড়ে গেল। জ্যোৎস্না নেমেছে। ঘাসের মধ্যে বাতাসাখানি খুজে পেলেন না ভিক্টোরিয়া। ননদিনীকে কাতর কণ্ঠে বলছেন, ও বউ, আমার সোয়ামি? হাতড়ে হাতড়ে সোয়ামিকে খুঁজে পেলেন। এবার আর হাতে নয়। মুখে পুরে মন দিয়ে চুষতে লাগলেন। যত চুষছেন--তত ব্যথা লাগছে। তবু কিছু বলছেন না। স্বামী তো। নিজেকে মন মনে বোঝালেন--স্বামী তো কিছু শক্তই হয়।

বাসায় এসে হারিকেনের আলোতে বাতাসাখানি মুখ থেকে বের করে ভিক্টোরিয়া ধরলেন। বলছেন, দ্যাখ তো বউ আমার সোয়ামী কেন এত শক্ত? শ্যামল এরপর লিখেছেন, অন্ধকারে বাতাসা ভেবে রাস্তা তৈরীর ছোট পাথর কুড়িয়ে মুখে দিয়েছেন ভিক্টোরিয়া।

কাণ্ড! এই বাইশাড়ি গ্রামে আমি বহুদিন গিয়েছি। মাছরং গ্রামের বটতলায় বসে থেকেছি। ভিক্টোরিয়া নামে ননদিনীর কথা আমাকে কেউ কখনো বলেনি। শ্যামল বলেছেন। বলেছেন, কিরণকুমারীর ছেলেটির নাম শ্যামল রেখেছিলেন সেই ননদিনী ভিক্টোরিয়া। এসো শ্যামল সুন্দর।

২.
গল্পটির শুরুতেই শ্যামল আমাদের একটা গান শোনাচ্ছেন--
আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি
যেন সে কিছুতেই বাঁশি না বাজায়
আজি নিশীথিনী ননদিনী
জাগিয়া জাগিবে প্রহরায়।

ইমন বিলাবল। দ্রুত একতাল। একটু তাল ঠুকেও দিচ্ছেন শ্যামল--ধা গেড়ে নাগ কদ্দি--ধেড়ে নাগ----। ঘুরে ঘুরে কাঠের খোলা উঁচু পাটাতনে গোয়ালিনী রাধা গাইছেন। এই পাটাতনটি কোথায়? বৃন্দাবনে? কৃষ্ণের বাড়ি গোপপল্লী? সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু শ্যামলের গল্পে সেটা পালামাঠে--সন্ধ্যানদীর কুলে। শ্যামল গোপপল্লীর গল্পটি কইছেন না। এটা নিশ্চিত করেন বাক্যের প্রথমেই পাটাতন শব্দটি দিয়ে। ইমেজটি তৈরি করেন--পাটাতনের সামনেই নীচে বৈকুণ্ঠ নট্ট বসে। তাকে ঘিরে খোল, করতাল, ঢোল, বাঁশি, ক্লারিওনেট বাজছে। এই গান বেঁধেছেন বৈকুণ্ঠ নট্ট। সুরও দিয়েছেন তিনি। পালাটিও তার রচনা। এ পালায় গিরিশ গাঙ্গুলি নামে বাইশাড়ী গ্রামের এক সম্পন্ন চাষী আয়ান ঘোষ সেজেছেন। আয়ান ঘোষের খালি গা। রীতিমত সুপুরুষ। উদাত্ত গলায় গান করতে পারেন। গল্পের বীজ এই আয়ান ঘোষ ওরফে গিরিশ গাঙ্গুলি।

বীজের মধ্যে প্রাণ থাকে। সেটা কিন্তু সত্যি নয়। প্রাণের ঘুমন্ত রূপ। এই বীজ ভেঙে যখন তার বিস্তারটি ঘটে, শেকড়, শাখা, প্রশাখা, পাতা, কুঁড়ি, ফুল, ফলে বৃক্ষ হয়ে ওঠে, আকাশ স্পর্শ করে, তখন সত্যিটা প্রকাশিত হয়। সে সত্যির কোনো সীমা থাকে। অরূপ হয়ে ওঠে।

এই রূপ ভেঙে ভেঙে অরূপটি বিনির্মাণ করেছেন শ্যামল এই সোয়া তিন পৃষ্ঠায়। শুরু হয়েছিল--বাইশারী গ্রাম থেকে। সেটা চলে এসেছে মীরাটে, না, দিল্লীতে, বরিশালে, কলকাতায়, শিয়ালদাহে, কুষ্টিয়া, খুলনা থেকে ইংলন্ডে। বঙ্কিম থেকে ম গান্ধিতে। ফাঁকে দেশবন্ধু থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়াতে। চলে গেছেন ননদিনী জটিলাকুটিলা থেকে কিরণকুমারিতে। মৃতস্বামী থেকে শ্রীকৃষ্ণে। বাতাসা থেকে রাস্তাবানাবার ছোট পাথরের টুকরোতে। পাথরের টুকরোটিকে আর পাথর বলে মানতে পারছেন না ষাটোর্ধ রাধাভাবে আকুল ভিক্টোরিয়া। পাথরের টুকরোটিকে ধরে নিয়েছেন সোয়ামি হিসেবে। সোয়ামি তো পাথরের টুকরোর মতোই। শক্ত। পাথর কি প্রাণে আরাম দিতে পারে? পারে না। ব্যথা দেন।

এইখানে ইমন রাগটি বাগেশ্রীতে এসে পড়ে। তাঁর রূপের রূপান্তর হয়ে যায়। বলে, সে যেন সে কিছুতেই বাঁশি না বাজায়। বাজালে ননদিনীকে এড়িয়ে অভিসারে যেতে হবে। দেখতে হবে আয়ান ঘোষ পাটাতনে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন-- আমারি বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া। পথে পথে কাঁটা। জঙ্গলের মধ্যে সাপ খোপ। যমুনা নদী ফুঁসে উঠেছে। আর কৃষ্ণের কাছে গেলে ব্যথা লাগে। ব্যথা ছাড়া আর কি আছে ভালোবাসায়?

৩.
এই ভালোবাসার গল্পটিই বলছেন শ্যামল। আমাদের সঙ্গে হাওলা করে দিচ্ছেন--আয়ান ঘোষের সঙ্গে গিরিশ গাঙ্গুলিকে। রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে বাইশারীর সদ্যোজাত ভিক্টোরিয়াকে। জটিলাকুটিলার সঙ্গে ননদিনী কিরণকুমারীকে। ঘর-ছাড়া-করা বাঁষিএ সঙ্গে প্রদীপের খোলা আগুণে। স্বামীর সঙ্গে বাতাসাকে। বাতাসার সঙ্গে কালো পাথরের টুকরোকে। এর সঙ্গে বাঁশি বাজে কি প্রকারে?

বাজে। শ্যামল বাজান। শ্যামল বাঁশি বাজিয়ে দেন শব্দের বিশ্বস্ত প্রয়োগে। পুরান থেকে ইতিহাসে। ইতিহাস থেকে সমকালে। শ্যামল আমাদের সঙ্গে সময় নিয়ে কানামাছি খেলেন। ঘটনাগুলো তার মতো করে ভেঙে দেন। ভেঙে যেতে যেতে নতুন একটা ঘটনার জন্ম হয়। সে ঘটনার ফাঁদে আমরা পড়ি। এই ফাঁদে পড়াটাই আমাদের নিয়তি। সেই নিয়তির বীজটি অঙ্কুরিত হয়। শাখা হয়। প্রশাখা হয়। পল্লবিত হয়। বৃক্ষের মধ্যে সৃষ্টিশীল প্রাণের জন্ম হয়।



আমি দেখলাম তোমাকে---
তোমার হাতে অনেক সুতোর টানায় হাজারো পুতুল বাঁধা
তুমি চুন খাবার ভঙ্গীতে একটা পুতুল দাঁতে কাটলে
মিষ্টি রসে মুখ ভরে উঠতে না উঠতেই
প্রয়োজন হলো নতুন পান সাজাবার
তোমার পিকদানী হয়ে উঠেছে পুতুলদের শ্বশ্মানঘাট।

দেখো, দেখো পুতুলনাচ দেখো
রানীটার হাতে পাখা
মিটমিটে চোখে মাথা ঘুরিয়ে ফ্রক তুলে নাচছে
ওর উরু বেয়ে নামছে রক্তিম ঋতুধারা
এখনো ওর মাঝে আছে দারুন সম্ভাবনা
এখনো সে জন্ম দিতে পারে আরেক পুতুলনাচের আসর।

দেখো, ঐ পুতুলটার কোলে আরেকটা পুতুল
তুমি দু’জনের মুখ থেকে চুল সরিয়ে দাও, চুল সরিয়ে দাও
চেটে নাও ওদের ঘাম, ক্লান্তি আর রতিবাসনা
যদি দেখায় কোনো অহমিকা
সুতো ধরে শুধু দিও একটা হ্যাঁচকা টান
তুমি তো জানো, এইসব পান আর চুন সবই তোমার আঙ্গুলের খেলা।

ভুল নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছি
তাই ভুলটা শুধরে নিতে শিখে গেছি
প্রত্যেকটা কাজেরই থাকে দুটো দিক
একটা ভুল আরেকটা ঠিক ।
ভুলের দিকে পা বাড়ালেই
অথবা পথে যেতে ভুল বেরিয়ে এলেই
থেমে, আবার পিছু হাঁটা
পুনরায় শূন্যে ফিরে আসা
তারপর আবার শুরু হয় চলা
এবার সঠিক দিকে নিশ্চিন্তে পা ফেলা
এভাবেই ভুলের অভিজ্ঞতাগুলোও
কাজে লেগে যায় ঠিকঠাক ...
জানি ... শিখে ঠকার চেয়ে
ঠকে শেখাই বুদ্ধিমানের কাজ ।।

[ বহুদিন আগে কবিতাটা লেখা । একদিকে পড়েছিল । দিয়ে দিলাম ... জানিনা কেমন লাগবে আপনাদের ... মতামত জানাবেন ]



কোন কোন সময় আকাশ খালি বাড়ী হয়, মেঘেরা অন্য কোথাও ঘুমিয়ে পড়লে
আকাশের লুকানো ব্যথাগুলো প্রকাশ পায় ঘন নীল রঙে, নির্বাক নীরবতায়
আকাশ হয়তো কবিতা লিখে উদাসী চোখ মেলে কোন দূর দিগন্তের
কিছু ফেলে আসা স্মৃতি নিয়ে, মেঘ হাওয়া ঝড়ের খেলা মেলায় যখন সময়গুলো
থাকতো কোলাহল ভরা, যখন আঁকা হতো রঙের সাঁকো দূর বলাকার চোখের
উষ্ণতায়, যখন বাজতো মিঠেল বীনা দমকে দমকে লচকা নাচে ঘাটে যাওয়া
কোন তরুনীর বেনী যার দুলতো প্রথম ফাগুন যেন নিমেষে
রংধনু রাগ, জীবনের প্রথম প্রেমের পরশ পাওয়ার অনাবিল ছটফটানিতে যে ছিল
কোন কিশোরের ধমনীতে প্রথম বন্যা, সেই সব স্মৃতি নিয়ে আকাশ কবিতা লিখে
আকাশের রঙ আরো নীল হয়।

আকাশের রঙ আরো নীল হয়, যখন সে বুঝে সে খুব একা,
যখন সে বুঝে চরাচরে তাকে ফেলে চলে গেছে সবাই, পাখী মেঘ বাতাস বা ঘুড়ি
যে যার কাজে, সে শুধু একা পড়ে রোগশয্যায় কোন একজন
যার আর নেই কিছু, যার শুধু দেখা বা শোনা দূরে কিছু ছায়া আবছায়া
ঘোরাঘুরি, নিশ্বাসের শব্দ বা পায়ের আওয়াজ,
যার শুধু একা থাকা, মৌনতায় শুন্যতায় ডুবে যাওয়া নিজেকে ভেঙ্গেচুড়ে
পুরনো গানের একাকী সুরে......

মেঘহীন সে আকাশ নীল থেকে আরো নীল হয়, খা খা রোদে পুড়ে।

ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে চলে গেল
ঝাপসা অবয়ব যতদূর দেখা যায়
দূরে হুইসেল বাজে শুধুই
সর্পিনী’র ফোঁসফাঁস এই অন্ধকারেও ঝংকৃত হয়
হায় শেষ ট্রেনও চলে গেল!
বিষন্ন আঁধারে একাকী মাঠ আজ নিঃসঙ্গ।

দূরে লণ্ঠনগুলো ঢিমে তালে হেঁটে যাচ্ছে
তালশাঁসের নরম ছোঁয়ার এক ফালি আলো,
পথিকজনে দেখাবে কি পথ?
অবিমিশ্র অনুভুতি একক জোয়ারে ভাসায়
ঢেউয়ের প্রথম দোলা উপরে তুলে আশা জাগায়
দ্বিতীয় দোলায় নেমে যাওয়া ঢেউ ঘুমের গুণ ধরে টানে।

একাকী মাঠে টুপ করে ঝরেছে হিম
স্টেশনের ভেতরে মাস্টার নিয়মভঙ্গ করছে দ্রুত
ট্যাপের অবিরাম টুপটাপ
এখানে জল পরে---জল পড়ে তবু পাতাটি না নড়ে
কুকুরটা হয়েছে কারো পাশবালিশ
মাঠ থেকে উঠে এসে কেউ বেঞ্চিতে মাথা এলায়।

হৈ চৈ আর কর্মময় ভোরের শুরুতেই
কেটে গেল রাতের বিবমিশা
পরবর্তী ট্রেন আসবার ঘোষনা বাজছে মাথার উপর
গত রাতটা কেমন বাসি হয়ে উঠলো মূহুর্তেই
ট্রেন ছেড়ে গেলে এমন নিঃসঙ্গ রাত সঙ্গী হলেই কি
নতুন উদ্যোমে রাতটা দিনের আলোয় নিজের ভাষা খুঁজে নিল।


কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নিরপরাধ প্রমান করবার ব্যার্থ চেষ্টা নিয়েও দেখি কোথাও যেন জেগে উঠছে নতুন চর। চরের দখলদারিত্ব নেবার সৎ সাহস নেই বলেই এড়িয়ে যাচ্ছি এই শোকবার্তা। আমরা মানবিক নই। এখনও ভয় পাই সামনে এগিয়ে যেতে। একজন ঋষি অনেক আগেই বলেছিলেন, ‘পেছনে তাকিয়ো না। যারা তাকায় তারা পাথর হয়ে যায়।‘ হয়তো তাই নিজের পাথুরে অবস্থান নিয়ে গর্বিত হয়েও কাঠাগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকি ঠাঁয়। সদা হাস্যময় আছি বলে কেউ জানেনা আসলে আমি কতটা স্থবির!


বিকেল বেলায় লনের দোলনাটা নড়ে উঠলো। বসে আছি রোদ্দুরহীন এক জনপদে। এখানে পাহাড় নেই, পাহারা আছে। পাহাড় ঠেললেও সরে না, পাহারাও ঠেলে সরাতে পারছি না। সামনের আমগাছের ডালটাকে একমনে চিরে যাচ্ছে বোকা কাঠঠোকরা। প্রজাপতির নামে হুলিয়া জারি হয়েছে। মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়েও তাই বাতাসের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। আমি একহাত দূরে বসে নামতা মুখস্থ করে যাচ্ছি অনর্গল---দুই একে দুই, দুই দুগুণে ছয়।

(দুই একে দুই, দুই দুগুণে ছয়
হিসাব মেলেনি তো?
বলবে দুই, দুই চার? কিনতু---
তুমি-আমি এক হলেই সংসার
দু’টো ফুটফুটে শিশু
এখনো বলবে দুই দুগুণে ছয় নয়?)


ভুল করিনি, ভুল আমার হয় না। নির্বাচনে কারচুপি না হলে আমলাতন্ত্র নিয়ে কথা বলা যেত। রাত নামলে কিছু তারা চিনিয়ে দেব। যেসব তারারা এক সময় সারারাত ঝগড়া করতো আজ ওরাও কেমন নিষ্প্রভ হয়ে আসছে। আসলে মনের মত মন না হলে বিবাদেও মন ভরে না।

তোমরা কি ভাবো আমার শরীরের এই কাঠামোর ভেতর নির্জিব কোনো প্রেত বসত করে? আমার তো মনে হয় এটা শ্মশ্বান ঘাট।


এখন লিপস্টিক বিষয়ক উপাখ্যান লিখতে বসিনি যে রক্ত আর রঙের ফারাক বুঝব না। আমার তো মনে হয় সবটাই চোরাবালি। ডুবে ডুবে জল খাওয়া আর লুকিয়ে চুমু খাওয়া খুব মিষ্টি। অনশন ভেঙ্গে জল খাওয়া যায় বৈ কি! চুমু খেলেই কেউ কেউ চোখ ঠেরে চায়, যেন এসবে কত্তো অপরাধ। ঠোঁট তো মাটির ঘড়া নয় যে ভেঙ্গে যাবে। ঠোঁট হলো অথৈ সাগর। অনশন ভাঙতে চাইলে এর চেয়ে মিষ্টি আর কি আছে, বলো!


এবারের বৈশাখীতে নাগরদোলায় চড়া হলো না, হয়নি গত ক’য়েকটি বছরও। বয়স বাড়ছে না কমছে এ নিয়ে যেমন বিতর্ক আছে তেমনি সামনে আর কতগুলো জ্যৈষ্ঠি স্মৃতিময় বাহারী রঙ্গে উল্লসিত হবে এ নিয়েও কম দ্বিধা নেই। চলন্ত ট্রেনের পেছনের সিটে বসে চলে যাচ্ছে সময়। আয়নায় শোকগাঁথা লিখে রাখছি। আজ থেকে পাঁচবছর আগেও এত কুঞ্চন পড়েনি ত্বকে। ঠিক এইমূহুর্তেও যেমন ঝরে গেল ত্বকের আরেকটি কোষ। পাঁচবছর পর হয়তো আবার টের পাব এই দিনে কেমন করে তার মৃত্যু হয়েছিল। আজকের দিনের জন্যে এটিই ছিল সর্বশেষ শোক সংবাদ।


একটা মানচিত্র এঁকে দেবে? এতে থাকবে লোনা জল, সতেজ চা-গাছ আর কিছু জ্যামিতিক বিন্যাস। এই ধরো ত্রিভূজ, বৃত্ত আরো কি সব। একটা বন্য শুকরও দিতে চাও? দাও তো! কিছুই ফেলে দেব না। ভয়াবহ কিছু চিত্র ছাড়া একটা দ্বীপ পরিপূর্ণ হয় না। এসো তবে দ্বীপ বিষয়ে ভাবতে বসি। কথা ছিল এখানে শুধুই আমাদের বসবাস হবে---তুমি আর আমি। সমুদ্রের নীচ থেকে পম্পেইয়ের ধ্বংসাবশেষ উঠে আসলে আমরাও হিসাব দিয়ে দেব কতটা পেয়েছি বা পাইনি। পরিপূর্ন মানচিত্রে কেবল দু’টো পুতুল এঁকে দিও বেশ আয়েশে। তাহলে হিসাব হবে বরাবর।

যখন যাবেই তুমি এইবার পুরোপুরি যাও
প্রশস্ত দরজা খোলা চারিপাশ প্রহরীবিহীন
ঝর্ণার জলের দিকে যে হরিণী মুখ রেখে শুত
তাকেও দেখেছি আমি শেষ হ’লে সিক্ততার দিন

অরণ্যে গভীরে যেতে। তার ঘন পদচ্ছাপ ভাসে
নরম কাদার গর্তে- দূর থেকে হেমন্তের ফুল
ঝরার সুবাস আসে। এই ঝরা কত সাবলীল
ঋতুর রিক্ত গাছ তার দৃশ্য নিয়ে নির্ভুল

সুঠাম দাঁড়িয়ে থাকে। যাবে যদি পরিপূর্ণ যাও
নদীর বিরুদ্ধ জল যেমন খর্ব করে বাঁধ
সে যাওয়ার মত নয়, নয় কোনো গুমোট হাওয়াও
সংকোচে লঘুতা বাড়ে- আমি খুঁজি তোমার অগাধ।

বড্ড গরম পাশ ফিরে শুই, পাইনা বাতাস নাকে
বাড়ছে জ্বলন, বিচলিত মন, আমায় কি কেউ ডাকে ?
তাপমাত্রা বাড়ছে দেখ, শুয়ে থাকাই দায়
চিতার আগুন মুচকি হেসে আমায় ছুঁতে চায়

উল্লাসে মন ছুটি ছুটি হাল্লা রাজা যেন
পৌঁছে গেলাম স্বর্গদ্বারে ক্লেশ হয়নি কোন
লম্বা সে লাইন নারী পুরুষ জন্মদিনের বেশে
খোলামেলা অবাধ হাসি ভগবানের দেশে

যখন আমায় ডাক দিয়ে যায় শেষ বিচারের তরে
সুন্দরী এক হাত ধরে মোর পৌঁছে দিল দ্বারে
আছেন বসে মোর ভগবান, ন্যায় বিচারের দেবী
অসামান্যা রূপসী এক, পটে আঁকা ছবি

দশ আঙ্গুলের ছাপ আর রেটিনা স্ক্যান করে
হিস্ট্রি আমার প্রকট হল মনিটরের পরে
চোখ বুলিয়ে এক নজরেই দেবী দিলেন রায়
নরক বাসের সাজা দিলাম হাজার বছর প্রায়

আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতে কিছু চাও ?
চাই বইকি, লাস্ট চান্স’তো, বলতে যদি দাও
দেখুন ম্যাডাম যা করেছি, জানানো প্রয়োজন
করেছে সব আমার দেহ, সঙ্গে ছিল মন

পঞ্চ ভূতে দেহ বিলীন চিতায় নির্বিবাদ
ক্ষিতী, অপ্, ত্যেজ, মরুৎ ও ব্যোম, সঙ্গে কিছু খাদ
মনটি ছিল নেহাত একাই, ভাগ্যে আপনি ছিলেন সাথে
সাত ভাগের এই কর্মফল, এক ভাগেরই পাতে ?

বলি তোমায় মনের কথা, ন্যায় বিচারের দেবী
তৈরি আমি খাটতে সাজা, একটি আছে দাবি
প্রিয়ে তুমি, যা বলবে, হাজার বছর নাও
একটি বছর আমার সাথে সঙ্গ যদি দাও -

এমন সময় উঠল বেজে দেবীর সেলফোন
অবাক কাণ্ড ঠিক যেন এ আমারই রিংটোন
একটু বস, বলে তিনি আড়াল হলেন যেই
সব কেমনই ঝাপ্সা ধোঁয়া, হারিয়ে গেল খেই

গিন্নি আমার ফোন করেছেন সাত সকালে ভাই
বুড়ো বয়েসেও দেখছি তোমায় একা ছাড়তে নাই
যেইনা গেছি ভাইয়ের বাড়ি, নেইকো আমি কাছে
ঘুমোয় পড়ে নাক ডাকিয়ে, জল দিয়েছ গাছে ?

About this blog

hit counter

Sample text

ফেসবুকে আমাকে ফলো করুন

ভিজিটর কাউন্ট

Resources

মোট পোস্ট হল

জনপ্রিয় পোস্ট গুলি

আজকের তারিখ হচ্ছে

Powered by Blogger.

Ads 468x60px

Social Icons

সমস্ত পোস্ট গুলি এখানে

Featured Posts